বাংলাদেশের স্থপতিরা জাতীয় সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের অসামান্য প্রতিভা প্রদর্শন করছেন এবং স্থাপত্যের ক্ষেত্রে নিরলসভাবে অগ্রগতি অর্জন করে চলেছেন। এই ধরনের একজন গুণী স্থপতি হলেন ইফতেখার আব্দুল্লাহ। তিনি বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, এবং অস্ট্রেলিয়াতে তাঁর স্থাপত্য চর্চা অব্যাহত রাখছেন। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়াতে একজন নিবন্ধিত আর্কিটেক্ট হিসেবে কাজ করছেন এবং সিডনি, মেলবোর্ন, ও ক্যানবেরায় তাঁর কিছু অসাধারণ কাজ রয়েছে। ইফতেখার আব্দুল্লাহ পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন স্থপতি যিনি বিভিন্ন প্রদর্শনীতে তাঁর কাজের জন্য সম্মানিত হয়েছেন। তাঁর সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হল সিডনির ‘ইস্টলেক হাউস’।
ইস্টলেক হাউস একটি একক পারিবারিক নিবাস, যা একটি উন্মুক্ত পরিকল্পনা, দ্বিতল উচ্চতা, এবং বৃহত জানালাগুলোর মাধ্যমে চোখ ধাঁধানো নান্দনিক সাজে সজ্জিত। এই বাড়িটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে দিনের আলো পুরো ইন্টেরিয়রে নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। এটি একটি দ্বিতল আবাসিক স্থাপনা, যার মোট আয়তন ২৮২ বর্গ মিটার এবং সংলগ্ন উন্মুক্ত অংশের আয়তন ৩৭০ বর্গ মিটার।

Source: Bandhan Magazine
লুইস ব্যারেগান তাঁর প্রিজকার স্থাপত্য পুরস্কার গ্রহণের বক্তব্যে উল্লেখ করেছিলেন যে, ২১ শতাব্দীর স্থাপত্য সৌন্দর্য, অনুপ্রেরণা, জাদু এবং মোহনীয়তা থেকে সরে আসছে এবং একই সঙ্গে নির্মলতা, অন্তরঙ্গতা ও মনোমুগ্ধকর ধারণা থেকেও দূরে সরে যাচ্ছে। তিনি বলেছিলেন যে মানুষের মন এমন এক রহস্যময় জায়গা যা ঋতুর পরিবর্তনের সাথে বদলায়, বাতাসে ভাসে এবং প্রকৃতির আলোর সঙ্গে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে, এই স্থাপনাটি নির্মিত হয়েছে। এটি একটি পরিবেশবান্ধব স্থাপনা যেখানে প্রতিটি কক্ষে প্রাকৃতিক আলো ও বায়ুর সমন্বয় রয়েছে। বাড়ির বারান্দাগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে গ্রীষ্মের রোদ সরাসরি প্রবেশ না করে এবং শীতকালে সূর্যের আলো এবং উষ্ণতা বিস্তৃতভাবে পাওয়া যায়। এছাড়াও, অস্ট্রেলিয়ার জলবায়ুর বিশেষত্বের কারণে ভবনটিতে ক্রস ভেন্টিলেশন পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে। এই ডিজাইনের ফলে পুরো বাড়িতে গ্রীষ্মকালে স্বাভাবিকভাবে বাতাস প্রবাহিত হয়, যা আলাদা করে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন পড়ে না।
এই স্থাপনার অন্দরসাজসজ্জা সমান গুরুত্ব পেয়েছে। ভবনের ভেতর ও বাইরের দেয়ালজুড়ে রঙিন কাচের ব্যবহার লক্ষণীয়, যা শুধু আলো প্রবেশের একটি অসাধারণ উপায় নয়, বরং এর রঙের ভিন্নতা ভবনে বসবাসকারীদের মনোজগতে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। ডিজাইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ফ্লোর এরিয়াকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করে একটি সম্পূর্ণ বাসযোগ্য এলাকা তৈরি করা। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, স্থাপনাটিতে পাঁচটি বেডরুম, তিনটি বাথরুম, তিনটি লিভিং এরিয়া, দুইটি রান্নাঘর, একটি বার, একটি দ্বিতল গ্যারেজ এবং ১২০ বর্গ মিটারের একটি লন রয়েছে।

Source: Bandhan Magazine
অধিকাংশ উন্নত স্থাপত্য নকশার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এর সমসাময়িক বিন্যাস, যা প্রাপ্ত জায়গা ও সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগায় এবং পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে। এই ভবনের বিশেষত্ব হলো এর বড় বারান্দা, যা গাছগাছালিঘেরা এবং ভবনের গোপনীয়তা রক্ষা করে। এছাড়াও এটি রাস্তার দৃশ্যমান অংশের সাথে সংযুক্তি স্থাপন করে, যা চাক্ষুষ আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং একটি সুন্দর এবং স্বতন্ত্র স্থাপত্যশৈলী প্রদান করে। এই নকশায় বিদ্যমান বিল্ডিংয়ের বাইরের গাছগুলির কোনো ক্ষতি না করে পরিকল্পনা করা হয়েছে। স্থাপনার কাঠামো পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব কারণ এটি ‘টিম্বার স্টাড’ স্ট্রাকচারে গঠিত, যা প্রাকৃতিক ‘গ্রোউন টিম্বার’ পদ্ধতি অনুসরণ করে নির্মিত, যা পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং কোনো প্রকার পরিবেশগত প্রভাব ছাড়াই। কাঠ তৈরির জন্য কোনো কলকারখানার প্রয়োজন হয় না, যার ফলে শক্তির অপচয় ঘটে না এবং এটি আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে টেকসইতা নিশ্চিত করে।
নকশার ধারণা পরিবেশগত ও সামাজিক স্থায়িত্বকে ব্যাপক অর্থে একত্রিত করে। এই ভবনটি এমনভাবে নির্মিত হয়েছে যে, এর পরিবেশগত প্রভাব কমিয়ে তাপ, শীতলতা ও আলোক শক্তির চাহিদা ন্যূনতম রাখা হয়েছে। ভবনের ডিজাইন প্রাকৃতিক বায়ু চলাচলকে নিশ্চিত করে, যা গ্রীষ্মের তাপ প্রতিরোধ করে এবং শীতকালে উত্তরের সূর্যকে স্বাগত জানায়। এছাড়া, বৃষ্টির পানি পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে এই ভবনের পানির চাহিদার একটি বড় অংশ মেটানো হয়। সিডনির সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্টে অবস্থিত এই ভবনটি সেখানকার আবাসিক প্রকল্পের জন্য একটি অনন্য পরিচয় তৈরি করেছে, যার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছিল ২০১৫ সালের আগস্টে।
সূত্র:
১. প্রধান স্থপতি: ইফতেখার আব্দুল্লাহ
প্রতিষ্ঠান: আইডিয়াস-ইফতেখার+ডিজাইন অ্যাসোসিয়েটস, ১৭ ওয়াররাগ্যাম্বা ক্রিস, লিউমি হাইট, এনএসডব্লিও ২৫৬০, সিডনি
প্রকল্প দল: ইফতেখার আব্দুল্লাহ, আশরাফুল আমিন জয়, শামিম-উর-রহমান
২. আলোচনায়: স্থপতি শফিক রহমান
আলোকচিত্র: ফায়জুর রহমান
৩. অনুলেখন ও অনুবাদ: তাহিয়া তাবাচ্ছুম তৃণা, পঞ্চম বর্ষ, স্থাপত্য বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি
৪. প্রকাশকাল: বন্ধন ৭১ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১৬
প্রকাশনায়ঃ আকিজ ব্রডকাস্ট মিডিয়া লিমিটেড
- বাংলাদেশি স্থপতির অনন্য কীর্তি - March 9, 2025
- বিস্ময়কর লবণ খনি ভিয়েলিচ্কা: এক ভূগর্ভস্থ রূপকথা - February 25, 2025